সারোগেসি এমন এক ধরনের পদ্ধতি যেখানে সন্তান জন্মদানের জন্য গর্ভ ভাড়া নেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে একজন নারী তার নিজের গর্ভে অন্যের সন্তান বড় করেন ও জন্ম দেন। গর্ভধারণের কাজটি যে নারী করেন তাকে ‘সারোগেট মাদার’ বা ‘সারোগেট মা’ বলা হয়। বর্তমান বিশ্বে ‘সারোগেসি’ খুব প্রচলিত একটি শব্দ। আর এই শব্দটিকে জনসাধারণের মাঝে পরিচয় করিয়েছেন বিশ্বজুড়ে খ্যাতিমান তারকারা।

সারোগেসি কী?

সারোগেসি মূলত একটি প্রজনন পদ্ধতি। যেখানে বাবা-মা সন্তান নেয়ার জন্য অন্য নারীর গর্ভ ভাড়া করেন। ওই গর্ভধারিণী মাকে ডাকা হয় সারোগেট মাদার। আর অন্যের সন্তান নিজের গর্ভে ধারণ করার বিনিময়ে ওই নারী আর্থিক লেনদেন করে থাকেন। এছাড়া গর্ভকালীন অবস্থায় ওই নারীর যত্ন ও সব ধরনের খরচের দায়িত্ব গর্ভে থাকা সন্তানের বাবা-মা নিয়ে থাকেন।

সারোগেসি’র পেছনের কারণ

অনেক চেষ্টার পরেও যখন সন্তান জন্মদানের আশা থাকে না তখনই একটি দম্পতি সারোগেসির শরণাপন্ন হন। সারোগেসির পেছনে আরও নানা কারণ থাকতে পারে। যেমন
◽বারবার চেষ্টা করেও গর্ভপাত হয়ে যাওয়া।
◽অসময়ে নারীর মেনোপজ বন্ধ হওয়া।
◽আইভিএফ চিকিৎসার পরও গর্ভধারণ না হওয়া।
◽জরায়ুতে অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়া।
এছাড়াও অনেকে সন্তান ধারনের কষ্ট সহ্য করতে না পেরে অথবা ব্যস্তাতার কারণে বা শারীরিক সৌন্দর্য ধরে রাখতে, বিয়ে না করে বাবা/মা হওয়ার ইচ্ছে থেকে সারোগেট বেবি নিয়ে থাকেন।

সারোগেসির পদ্ধতি কী?

সারোগেসি সাধারণত দুই ধরণের হয়।
১. পার্শিয়াল সারোগেসি এবং
২. আরেকটি ট্রু সারোগেসি। পার্শিয়াল সারোগেসিতে সন্তানধারণে মা কোনো ভূমিকাই পালন করেন না। বাবার শুক্রাণু আর সারোগেট মায়ের ডিম্বানু থেকে জন্ম হয় শিশুর। অন্যদিকে, ট্রু সারোগেসিতে মায়ের ডিম্বাণু এবং বাবার শুক্রাণু নিয়ে ল্যাবে ভ্রূণ তৈরি করা হয়। এরপর সেই ভ্রূণ সারোগেট মায়ের ইউটিরেস বা জরায়ুতে প্রতিস্থাপন করা হয়। বর্তমানে সারোগেসির এই পদ্ধতিটি বেশিরভাগ দম্পতি গ্রহণ করেন। অন্যদিকে, পার্শিয়ালে সাধারণত সারোগেট মাদারের ডিম্বাণু এবং গর্ভ ভাড়া নেয়া হয়। ফলে এই পদ্ধতিতে সন্তানের উপর সারোগেট মাদারের একটি জৈবিক অধিকার থেকেই যায়। তবে ট্রু সারোগেসিতে দম্পতির পিতৃত্ব বা মাতৃত্ব নিয়ে কোনো সংশয় থাকে না। কারণ এই পদ্ধতিতে মায়ের শুক্রাণুর সঙ্গে স্পার্ম ব্যাংকের অন্য পুরুষের শুক্রাণু কিংবা বাবার শুক্রাণু অন্য মহিলার ডিম্বানুর সঙ্গে নিষিক্ত করে ভ্রূণ তৈরি করা হয়।

সারোগেসিতে খরচ

কোনো কোনো দেশের আইনে সারোগাসি বৈধ, আবার কোনো কোনো দেশে অবৈধ। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ভারত ছিল কমার্শিয়াল সারোগেসির হটস্পট। সারোগেছি বিল ২০১৬ পাস হওয়ার পর বাণিজ্যিক সারোগেসি নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। তবে আলটুরিস্টিক সারোগেছি চালু আছে। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক সারোগেসি প্রচলিত আছে। আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে ভারতের খরচ আনুমানিক ৬০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়াও সারোগেট মায়ের সুস্থতা ও চিকিৎসায় তার পেছনেও অনেকটা খরচ হতে পারে। সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান পেতে অনেক ক্ষেত্রে সারোগেট মায়ের আনুষঙ্গিক খরচের পরিমাণ ৩০-৫০ লাখ টাকাও হতে পারে।

সারোগেসিতে স্বাস্থ্যঝুঁকি

সারোগেসি খুব একটা সহজ পদ্ধতি নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে একাধিক জটিলতা ও ঝুঁকি থাকে। প্রথমত, ভ্রূণের জীবনের প্রিইমপ্ল্যান্টেশন, প্রসবপূর্ব ও নবজাতক সময়কালে ব্যর্থতার সম্ভাবনা থাকে। ডিম্বাশয় উদ্দীপনা, পরবর্তী আইভিএফ চক্র ও আইভিএফ ও জেনেটিক ল্যাবরেটরির মধ্যে ভ্রূণ, পেরিনেটাল ও নবজাতক সময়ের মধ্যে নিযুক্ত কৌশলগুলোর মতো একাধিক জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি আছে।

সারোগেসি: যা বলছে ইসলাম

সারোগেস পদ্ধতিতে সন্তান জন্মদানের কারণে যেসব সমস্যা সৃষ্টি হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো-সারোগেস পদ্ধতির মাধ্যমে বংশ-পরিক্রমা বাধাগ্রস্ত হয় এবং পর পুরুষের বীর্য বা শুক্রাণু পরনারীর জরায়ুতে প্রবেশের মাধ্যমে ভ্যবিচারের মতো জঘন্য পাপ হয়। নবি কারিম (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহ এবং কিয়ামত দিবসের প্রতি বিশ্বাস রাখে, তার জন্য নিজের পানি (বীর্য) দিয়ে অপরের ক্ষেত সেচ করা বৈধ নয়। (সুনানে আবু দাউদ, ১১৩১)। এ ছাড়া সারোগেসির মাধ্যমে জন্ম নেওয়া শিশুর মা আসলে কে হবেন, তা নিয়ে সৃষ্টি হয় জটিলতা। পবিত্র কুরআনের বিধান অনুযায়ী জন্মদাত্রী নারীই হন সন্তানের মা। আল্লাহ বলেন, ‘তাদের মা তো শুধু তারাই, যারা তাদের জন্ম দিয়েছে’। (সূরা : মুজাদালাহ : ২)।

জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সন্তান গ্রহণের জন্য নির্দিষ্ট পদ্ধতি পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলে দিয়েছেন। কোরআনে আছে, ‘তিনিই তোমাদের এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন ও তার থেকে তার স্ত্রী সৃষ্টি করেছেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়। তারপর যখন সে তার সঙ্গে সংগত হয় তখন সে এক হালকা গর্ভধারণ করে এবং এটা নিয়ে সে অনায়াসে চলাফেরা করে। অতঃপর গর্ভ যখন ভারী হয়ে আসে তখন তারা উভয়ে তাদের রব আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে, যদি আপনি আমাদের এক পূর্ণাঙ্গ সন্তান দান করেন তাহলে আপনার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকব। ’ (সুরা আরাফ, আয়াত : ১৮৯) অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, ‘আর যারা নিজেদের যৌনাঙ্গকে রাখে সংরক্ষিত, নিজেদের স্ত্রী বা অধিকারভুক্ত দাসীগণ ছাড়া, এতে তারা হবে না নিন্দিত, অতঃপর কেউ এদের ছাড়া অন্যকে কামনা করলে, তারাই হবে সীমালঙ্ঘনকারী। ’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ৫-৭)

বাস্তবতা হচ্ছে সারোগেট মা তার ভাড়া পাওয়ার পর সন্তানকে তার মালিকের কাছে হস্তান্তর করে ফেললে শিশুর মাতৃ পরিচয়টুকুও বিলুপ্ত হয়ে যায়। সন্তানের বৈধতা প্রশ্নের মুখে পড়ে। ওলামায়ে কেরাম মনে করেন সারোগেসি বা গর্ভ-ভাড়ার মাধ্যমে সন্তান জন্মদান ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ নাজায়েজ ও শরিয়তবিরোধী একটি কাজ। যা পরিত্যাগ করা মুসলিম নর-নারীর জন্য কর্তব্য। অতএব বর্তমান যুগে জৈবিক চাহিদা পূরণ ও সন্তান গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম নিজের বিবাহিত স্ত্রী। এর বাইরে কারো মাধ্যমে এসব চাহিদা পূরণ ঠিক নয়। ১৯৮৬ সালে জর্ডানের রাজধানী আম্মানে ইসলামিক ফিকহ একাডেমি কাউন্সিলের তৃতীয় অধিবেশনে সারোগেসিকে ইসলামে সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। বাংলাদেশে টেস্টটিউব বেবি আইনগত ভাবে বৈধ হলেও সারোগেসি এখনও বৈধতা পায়নি।